স্বদেশ ডেস্ক:
কাশ্মির কয়েক দশক ধরেই পরমাণু ফ্ল্যাশপয়েন্ট হয়ে আছে এবং উভয় দেশ ইতোমধ্যেই এটি নিয়ে তিনটি যুদ্ধ করে ফেলেছে। তারা অনেকবার যুদ্ধের কাছাকাছি এসেছিল এবং বর্তমান সময়ে আবারো ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। উভয় দেশ পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ায় এখন প্রথমে আমাদেরকে যুদ্ধের ধরন ও উভয় সামরিক বাহিনীর অবস্থা পরিমাপ করতে হবে। আমাদের জানতে হবে কে এগিয়ে আছে এবং কেন?
অনেক ধরনের যুদ্ধকৌশল রয়েছে এবং পাকিস্তান ও ভারতের মতো দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে এসবের কোনো একটি বা একাধিক কৌশল প্রয়োজ করছে। এগুলোর কয়েকটি হচ্ছে গভীর সমুদ্র যুদ্ধকৌশল, মহাকাশ যুদ্ধ, সিআই অপস (বিদ্রোহ দমন), তথ্য যুদ্ধ, ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধ, সীমিত যুদ্ধ ও দুই সামরিক বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি যুদ্ধ। পরমাণু যুদ্ধ ছাড়া ওপরে উল্লেখিত সবগুলোই যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়েই আমরা ভাবতে পারি, যুদ্ধের প্রস্তুতি সামর্থ্য যাচাই করতে পারি।
আমরা যদি পূর্ণমাত্রায় দুই সামরিক বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি যুদ্ধের কথা বলি, তবে সামরিক বাহিনীর কয়েকটি বিষয়ের দিকে আলোকপাত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। প্রথমত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুদ্ধ করার জন্য সামরিক বাহিনীর হাতে থাকা অস্ত্র। দ্বিতীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যুদ্ধের দক্ষতা। যুদ্ধের জন্য বাহিনী কতটা কঠোরভাবে প্রশিক্ষিত এবং প্রাপ্ত অস্ত্র ব্যবহারে কতটা দক্ষ সেটা এর মধ্যে পড়ে। আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিমান, স্থল ও নৌ বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয় কতটা রয়েছে। সমন্বিত যুদ্ধ করার জন্য এই তিন বাহিনীর মধ্যে অভিন্ন অবস্থান থাকতে হবে। আজকে আমাদের পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের কৌশলের ওপর নজর থাকবে। আর এর মাধ্যমেই কোন বাহিনী কতটা বেশি যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে, তা দিয়ে উপসংহার টানা হবে।
দুই সামরিক বাহিনীর মধ্যে প্রস্তুতি পরিমাপ করার জন্য আমরা অবশ্যই ১৯৯০ সাল থেকে ঘটনাগুলো ও এর প্রতিক্রিয়াগুলো বোঝার চেষ্টা করব। ভারত ১৯৯০-এর দশকে প্রবেশ করে দুর্দান্ত কৃতিত্ব নিয়ে। ১৯৮৪ সালে তারা অপারেশন মেঘদূত (সিয়াচিন) ও ১৯৮৭ সালে অপারেশন রাজিব (কায়েদ পোস্ট নামে পরিচিত পাকিস্তানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ দখল) পরিচালনার মাধ্যমে। ১৯৯০-এর দশকে কাশ্মিরে ভারত তাদের সশস্ত্র বাহিনী বাড়াতে থাকে, হাজার হাজার সৈন্যকে সেখানে মোতায়েন করে। তারা বিদ্রোহ দমন যুদ্ধে নিয়োজিত হয়। এরপর সামরিক প্রশিক্ষণে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ থেকে বিদ্রোহ দমনের কৌশলে পরিবর্তন করে ভারত।
ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল যোশি ১৯৯৩ সালে বিদ্রোহ দমনের জন্য মূলধারার সেনাবাহিনী থেকে আলাদা করে পৃথক একটি বাহিনী গঠন করেন। এই ধারণাকে বাস্তব রূপ দিতে তিনি আধা সামরিক একটি বাহিনী গড়ে তোলেন রাষ্ট্রীয় রাইফেলস (আরআর) নামে। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত লোকজন কেউই আরআরে যোগ দিতে চায়নি। কারণ এতে একদিকে যেমন আছে ঝুঁকি, অন্যদিকে তাদের ক্যারিয়ার গঠনে তা ফলপ্রসূ হয় না।
ফলে জেনারেল যোশি হন এই বাহিনীর কর্নেল কমান্ড্যান্ট, যাতে বাহিনীটি লাইমলাইটে থাকে এবং তরুণ ও দক্ষ অফিসারেরা এখানে দায়িত্ব পালনে আগ্রহী হয়। কিন্তু এতে নেতিবাচক প্রভাবও পড়ে। কারণ এটি সেনাপ্রধানের রেজিমেন্ট হওয়ায় প্রত্যেকেই এখানে নিজেকে তুলে ধরতে ও ক্যারিয়ারকে সামনে এগিয়ে নিতে এখানে কাজ করতে আগ্রহী হয়। তারা মনে করতে থাকে, বিদ্রোহ দমনের এই বাহিনীতে কাজ করলে তাদের পদোন্নতি হবে দ্রুত।
এখন একটি পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনী তার দায়িত্ব পালনের জন্য বিদ্রোহ দমনকারী বাহিনীর মতো দেখাচ্ছে। এতে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের জন্য গড়ে তোলা একটি সেনাবাহিনীর পরিসর সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। তারা এখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ছোট ছোট লড়াই করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। ১৯৯৩ সালৈর পর ভারত তার সীমান্তে বেড়া দেয়ার কাজটিও সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারতীয় অর্থনীতির ওপর কেবল চাপই সৃষ্টি হয়নি, সেইসাথে ভারতের শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানেই এনে দেয়।
সত্যিকার অর্থেই আপনি যখন আপনার সীমান্তে বেড়া দেবেন, তখন আপনার ট্রেনিং ম্যানুয়াল আপনার পরিকল্পনা সীমিত হয়ে পড়বে, মানসিকতা হয়ে পড়বে রক্ষণাত্মক। এই পরিবর্তন ও মানসিকতা লড়াই করার দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রভাব ফেলে। এর ফলে তারা এখন আক্রমণের বদলে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। বাহিনীকে পূর্ণ ভারসাম্যে রাখার জন্য তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে দেয়া ও নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কাশ্মিরে তা ঘটেনি। কারণ এখানে সেনাবাহিনী সহায়তা করছে পুলিশকে এবং তাদের কোনো সময়সীমাও দেয়া হয়নি। তারা রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। কাশ্মিরে ভারতীয় সেনাবাহিনী কয়েক দশক ধরে বেসামরিক দায়িত্ব পালন করে আমলাতান্ত্রিক প্রবণতা সৃষ্টি করছে, ধারালো অস্ত্রটিতে মরিচা পড়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এটা ক্ষমতার অপব্যবহারের সূচনা করে, লোকজনও ভয় পেতে শুরু করে।
কার্গিল যুদ্ধেও সামর্থ্য ও মানসিকতা নষ্টের বিষয়টি দেখা গিয়েছিল। এ সময় ভারতই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছুটে গিয়েছিল পাকিস্তান বাহিনীকে সরিয়ে নিতে মধ্যস্ততার জন্য। দ্বিগুণ আকারের একটি সামরিক বাহিনীর জন্য একটি অস্বস্তিদায়ক বিষয়। কার্গিল যুদ্ধে ভারত কোনোমতে মুখ রক্ষা করেছিল।
পুরো ঘটনাটি প্রকাশ করে দেয় যে ভারতের রক্ষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি এর আসল চিত্র দেখাতে শুরু করেছে। কারণ ভারত আন্তর্জাতিক সীমান্তে এই যুদ্ধ সম্প্রসারণ করতে সক্ষম নয়। আর সীমিত একটি যুদ্ধে বিপুল প্রাণহানি তার মানসিক ক্ষতির বিষয়টিই প্রকট করে তুলেছে। পরে ২০০০-এর দিকে ভারত তার সামরিক কৌশলে পরিবর্তন এনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নীতি গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে এর সামরিক কৌশল হয় আক্রমণাত্মক রক্ষণাত্মক এবং এই আক্রমণও আফগানিস্তানের মাধ্যমে অভিযানে বিদ্রোহের মাধ্যমে হয়।
তবে ভারত তার বিদ্রোহ দমনের কৌশল থেকে সরে আসেনি। এ কারণেই দুই সিনিয়র জেনারেলকে টপকিয়ে জেনারেল রাওয়াতকে সেনাপ্রধান করা হয় তার বিদ্রোহ দমনের অভিজ্ঞতার আরোকে। ২০১৩ ও ২০১৪ সাল নাগাদ ভারতের প্রক্সিগুলো পাকিস্তান ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেখা গেল, ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমিত যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুত নয়।
আমরা যদি পাকিস্তান ও এর সামরিক কৌশলের দিকে তাকাই, তবে বুঝতে পারব যে ১৯৯০-এর দশকের পর এখানে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ওই সময় কাশ্মিরে ভারত তার বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করলে মধ্যস্ততা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছুটে গিয়েছিল পাকিস্তান। এতে বোঝা যায়, পাকিস্তান তখন তার নিজের সামরিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছিল না। তবে তারা ভারতের বিপরীতে আক্রমণাত্মক ও রক্ষণাত্মক- উভয় ধরনের যুদ্ধের জন্যও ট্রেনিং ম্যানুয়াল বহাল রেখেছিল।
আমরা যদি পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে কার্গিল অপারেশনকে দেখি, তবে তা প্রত্যাশার মতো মনে হবে না। এতে পরিকল্পনাগত ভুল দেখা গেলেও পাকিস্তান যে সীমিত সময়ের জন্য যুদ্ধে প্রস্তুত, সেটাই প্রতিফলিত হয়। ভারত যদি এই যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক সীমান্তে নিয়ে যায়, তবে তারা যে প্রস্তুত, তা বোঝা গেছে।
৯/১১-এর পর এখন পর্যন্ত পাকিস্তান ব্যাপক বিদ্রোহ দমন অভিযান পরিচালনা করেছে। তবে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি হ্রাস করেনি। পাকিস্তান এফসি (ফ্রন্টিয়ার কোর) কেপিকে ও এফসি বেলুচিস্তানের মতো বেশ কয়েকটি নতুন আধাসামরিক বাহিনী গঠন করেছে। তারা সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রশিক্ষণও জোরদার করেছে। প্রতিটি অফিসারকে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত এফসিতে কাজ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
পাকিস্তান তার এফসিকে আরআরের মতো স্পটলাইটে আনেনি। বরং ভারতের বিপরীত কাজটিই করেছে। দেশটি তার নর্দার্ন লাইট ইনফেন্ট্রিকে নিয়মিত সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রক্ষা করার জন্য। এতে বোঝা যাচ্ছে, পাকিস্তান পশ্চিম দিকে চায় আত্মরক্ষা করতে এবং এতে তার আধা সামরিক বাহিনী নিয়োজিত করছে। আর পূর্বে সে আগ্রাসী ভূমিকায় থাকবে নিয়মিত সেনাবাহিনীর মাধ্যমে। ফলে মূলধারার সেনাবাহিনীর লড়াই দক্ষতা হ্রাস পাবে না।
পাকিস্তান তার পশ্চিম সীমান্তে বেড়া দিয়েছে এবং রক্ষণাত্মক কৌশলের অংশ হিসেবে বেড়া দিয়েই যাচ্ছে। বিদ্রোহ দমন করার জন্য পাকিস্তান তার সেনাবাহিনীকে সোয়াত ও ওয়াজিরিস্তানের মতো পশ্চিম এলাকায় পাঠিয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তান সর্বশেষ খণ্ডযুদ্ধে নিয়োজিত হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানে প্রবেশ করলে পাকিস্তানও জবাব দেয়। তারা প্রকাশ্য দিবালোকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুটি বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করে, একজন পাইলটকে আটক করে। এতে বোঝা যায়, ভারতের আগ্রাসী প্রদর্শনীকে ভয় পায় না পাকিস্তান। আর এ ধরনের প্রতিক্রিয়ায় প্রমাণিত হয় যে যেকোনো মাত্রার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত পাকিস্তান।
গত ৩০ বছরের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে আমরা উপসংহার টানতে পারি যে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে বাস্তবতা সম্পর্কে অনেক পরিবর্তন এসেছে। পাকিস্তান নির্দিষ্ট ধরনের যুদ্ধের জন্য তার সেনাবাহিনীর দক্ষতা সীমিত করেনি। তবে ভারত তা করেছে। কাশ্মিরে এসেছে ভারত এবং তাদের ৯ লাখ সদস্যবিশিষ্ট সেনাবাহিনীর মূলধারাটিই এখানে রয়েছে। তাদের উপত্যকাটি থেকে সরে যাওয়ার কোনো সময়সীমা না থাকায় তারা উন্নতমানের পুলিশে পরিণত হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে দক্ষ সেনাবাহিনীতে পরিণত হচ্ছে অনেক কম।
লেখক : উপ পরিচালক, সুক্কার আইবিএ বিশ্ববিদ্যালয়, সুক্কার, পাকিস্তান।
গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস/এসএএম